একটি ভালো উপন্যাস রচনার নিয়মগুলি কী কী?
উত্তর লেখার আগে প্রশ্নকর্ত্রী এণাক্ষী সাহা কে পাল্টা প্রশ্ন করতে চাই, 'আমি কেন?' হঠাৎ কি এমন মনে হল, যে এমন আকাট, অজ্ঞ লেখনীধারীকে এই পোশ্নোখানা করতে হল? উপন্যাসের 'উ' তো দূরের কথা, জীবনে কোনোদিন ছোটগল্পও লিখতে পারিনি। আজ যে কবিতাখানা ভাবাবেগের বশবর্তী হয়ে লিখে ফেলি, ২ বছর পর ডায়েরির পাতা উল্টে তার ছিরি দেখলে লজ্জার চোটে 'ধরণী দ্বিধা হও ' অবস্থার সৃষ্টি হয়। কাজেই আমার মুরোদের যা সৃষ্টি, তার সবই অনাসৃষ্টি! এ হেন আকাট কবিকে কেউ কিনা পোশ্নো করে -
এ একটা কথা হল? কাল সারাদিন ধরে একথা যতবার ভেবেছি, মনে মনে ততবার নিজের ক্ষ্যামতার ওপর ততই হেসেছি। ঠিক করেই রেখেছিলুম, প্রশ্নই ওঠে না এমন প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার। হঠাৎ রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে কি এমন মুড বদল হল, একেবারে ১৮০ ডিগ্রী উল্টে গেলাম! আগের সব যুক্তির পাল্টা যুক্তি লাগাতে শুরু করলাম। ভাবলাম, এই যে এত বড় বড় ফুটবল বোদ্ধারা লা লিগা, মেসি, রোনাল্ডো -সব নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করে ফুটবলের চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে দিচ্ছেন, এদের কতজন মাঠে গিয়ে ফুটবল খেলেছেন? এই যে এত বিরাট মানের ব্যক্তিত্ব যারা একের পর এক চলচ্চিত্র, ওয়েব সিরিজের রিভিউ দিয়ে কখনো সত্যজিৎ রায়, কখনও গঁদারের শিল্পবোধ নিয়ে থিসিস ঝেঁড়ে দিচ্ছেন, তাদের কতজন কটা সিনেমা বানিয়েছেন? মায় স্টুডিওতে কোনোদিন পা রাখেননি, এমন লোকও তো তাদের দলে আছেন, নাকি? অথচ ভেবে দেখুন, এরা যদি এই কাজগুলো না করতেন, তাহলে ওই মেসি, রোনাল্ডো কিংবা সত্যজিৎ রায়, আবার পাবলো পিকাসো -এঁরা হয়তো জনপ্রিয় হতেন, কিন্তু এমন সর্বজনবিদিত আর চিরস্মরণীয় হতেন কি? আমার তো অন্তত সন্দেহ আছে। আবার এঁদের সমালোচক আছে বলেই হয়তো এঁরা প্রগতির উৎসাহ পেয়েছেন।
তাই মোদ্দা কথাটা হল, আমি উপন্যাস লিখতে পারিনি ঠিকই, লেখার ইচ্ছেও নেই আপাতত, তাই বলে কেউ উপন্যাস লিখতে চাইছে, আর আমি 'উপদেশ' ঝাঁড়ব না, এ কেমন করে হয়? এমনিতেই আমরা বাঙালিরা বিনেপয়সায় উপদেশ দিতে একটা শৌখিনতা বোধ করি। ওসব ' আপনি আচরি ধর্ম, শিখাও অপরে ' মার্কা নীতিবাক্য আমাদের ঠিক হজম হয় না বাপু। যাই হোক, আর বাজে বকে কাজ নেই, নীতিমালার পাঠ ছেড়ে উপদেশগীতি গাইতে শুরু করি? একেবারে পয়েন্ট সহকারে.....
বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ : আমার যা মনে হয় তাই আমি বলছি কিন্তু, থিওরি ফেল করলে দায় আমার নয়। সোজাসুজি বললে, অ্যাডভাইস আমার, রিস্ক আপনার..... ;)
১. হতে হবে দায়িত্বশীল পাঠক : প্রথমেই যে জিনিসটা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে আমার মনে হয়, তা হল একজন আদর্শ পাঠকের পরিচয় দেওয়া । একজন ভালো সংগীতজ্ঞ যেমন প্রথমে একজন খুব ভালো শ্রোতা, তেমনি একজন ভালো লেখক সবার আগে একজন সুচিন্তিত পাঠক। আমার একজন শিক্ষক একবার আমায় বলেছিলেন -
কথাটা মোটেই অত্যুক্তি নয়। কাজেই যে বিষয়ে উপন্যাস লিখতে আপনি ইচ্ছুক, সেই জঁরার উপন্যাস পড়তে থাকুন একের পর এক। যত বেশি আপনি পড়বেন, বুঝবেন তত বেশি আপনি ইনভেস্ট করছেন আপনার ভবিষ্যৎ উপন্যাসের পেছনে। যত পড়বেন, ততই মানোন্নয়ন হবে আপনার লেখার।
.
২.উপন্যাসের কাঠামো চাই সুদৃঢ় : আমার কাছে, একটা খুব ভালো উপন্যাস লেখা একটা অত্যাশ্চর্যকর ভাস্কর্য বানানোর চেয়ে কম নয় মোটেই। ভাস্কর্য বানানোর জন্য যেমন আগে থেকে কাঠামো তৈরি করে নিতে হয়, তেমনি উপন্যাসের কাঠামোটাও মনের মধ্যে প্রোথিত করে নিতে হবে একেবারে শুরুতেই। ভাস্কর্য তৈরির কাজ যত এগোতে থাকে, তত এর সূক্ষ্ম শৈল্পিক স্পর্শের প্রয়োজন বাড়ে। উপন্যাসের ক্ষেত্রেও তাই। সূক্ষ্মতম বিবরণগুলো যোগ করা হয় মূল গঠন তৈরির পর। গল্প বা কাহিনির শুরুর প্রেক্ষাপট যেন যথেষ্ট আকর্ষণীয় আর সাবলীল হয়, কেননা -
First Impression is the Last Impression
আবার একই সাথে, উপন্যাসের ক্লাইম্যাক্সও যেন মন ছুঁয়ে যাওয়ার মতো হয়। না হলে পাঠকবর্গ আপনার পরবর্তী উপন্যাসের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করবেই বা কেন? উপন্যাসের দৈর্ঘ্য যেন কখনও এর প্রতি আগ্রহের অন্তরায় না হয়ে দাঁড়ায়, তার খেয়ালও কিন্তু রাখতে হবে।
.
৩. মনের পরিবর্তন যেন প্রভাব না ফেলে : আপনি নিশ্চয়ই অনেকদিন সময় নিয়ে উপন্যাসটা লিখবেন। খেয়াল রাখবেন, আপনার মন -মর্জির পরিবর্তন যেন উপন্যাসের কাহিনিকে কোনোভাবেই বিগড়ে না দেয়। তাই যে পরিস্থিতিতে, যতটা স্বাভাবিক অবস্থায় আপনি লেখা শুরু করেছিলেন, চেষ্টা করে দেখবেন যতবার লিখতে বসছেন, আপনার মেজাজ যেন ঠিক প্রথমদিনের মতই থাকে।
.
৪.আনতে শিখুন character arc : আপনার অর্জিত জ্ঞানের ওপর বিশ্বাস রাখুন। গল্পের কাহিনিতে কিছু অপ্রত্যাশিত মোড় বা চরিত্রের মানসিক পরিবর্তন আনার চেষ্টা করে দেখুন, যাকে চিত্রনাট্যের ভাষাতে Character arc বলে। কিন্তু এব্যাপারে যথেষ্ট নিশ্চিত না হলে ইচ্ছেমতো পরিবর্তন আনতে যাবেন না, কেননা পাঠকের মনে একবার উপন্যাসের বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হলে, সেই উপন্যাস পড়ার আগ্রহটাই চলে যায়। বাস্তবজীবনের অভিজ্ঞতা থেকে আশেপাশের মানুষের ভিন্ন পরিস্থিতিতে চরিত্রের পরিবর্তনগুলো লক্ষ করুন, ঠিক কাজে লাগবে।
.
৫.বিষয়বস্তু হতে হবে বিশ্বাসযোগ্য : এই পয়েন্টটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। একটা বিষয় আপনি মনের মধ্যে একদম গেঁথে নিন যে - আপনি ভালো উপন্যাস লিখতে সচেষ্ট, কোনো বাংলা মেগা সিরিয়ালের চিত্রনাট্য লিখতে বসেননি। এখানে আপনার যথেষ্ট স্বাধীনতা আছে ঠিক, তবে গল্পের গরুকে গাছে উঠিয়ে দেওয়ার অভিপ্রায় থাকলে ছেড়ে দিন। আরো পরিণত মননের দরকার উপন্যাস লেখার জন্য ; তা সে আপনি বড়দের জন্যেই লিখুন কিংবা ছোটোদের জন্যে।
.
৬.রহস্য সৃষ্টিতে আপনার দক্ষতাই শেষ কথা: রহস্য উপন্যাস বা গোয়েন্দা কাহিনি লিখতে হলে আপনাকে উত্তর অনুযায়ী প্রশ্ন তৈরি করতে হবে। মানে রহস্যের সমাধান থাকবে প্রথমেই আপনার জ্ঞানকোষে, সেই অনুযায়ী তৈরি করতে হবে রহস্যের নীল নকশা। এক্ষেত্রে আপনি যতটা মুন্সিয়ানার পরিচয় দিতে পারবেন, ততই সার্থকতা লাভ করবে আপনার লেখনী।
.
৭.শুরু করা যায় ছোট্ট প্রচেষ্টা দিয়েও : কোনো ধরনের ছোটোগল্প না লিখে সরাসরি উপন্যাস লিখতে যাওয়া কতটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে, এটা নিয়ে আমার কিন্তু বেশ সংশয় আছে। যদিও অনেক ঔপন্যাসিকই এমন আছেন, যারা ছোটোগল্প না লিখেই মারাত্মক ভালো উপন্যাস লিখে ফেলেছেন, কিন্তু আমার মতে, সবাই এই সাহসটা দেখাতে পারেন না। আসলে উপন্যাস লিখতে এতটা সময় লাগে যে সেই উপন্যাসখানা শেষ হওয়ার পর যদি নিজেরই ভালো না লাগে, তাহলে বড্ড বেশি অনুশোচনা হয়। তাই আমার ব্যক্তিগত মতামত, প্রথমে কয়েকটি বেশ যুৎসই ছোটগল্প বা প্রবন্ধ লিখে, অভিজ্ঞ মানুষের বিচার শুনে এদের উৎকর্ষতা যাচাই করে নেওয়াটা নেহাৎ মন্দ নয়। এতে করে উপন্যাস লেখার আত্মবিশ্বাস বাড়বে বৈ কমবে না।
.
৮. কাহিনীর ব্যাকগ্রাউন্ডে থাকবে আরো কত কল্পকাহিনী: এই পয়েন্টটাও খুব জরুরি, যদিও আগেই উল্লেখ করা উচিত ছিল। উপন্যাসের চরিত্রের সংখ্যা কিন্তু সাধারণত ছোটোগল্পের তুলনায় অনেক বেশি হয়। সমস্ত চরিত্রের বিবরণ উপন্যাসে করা হোক বা না হোক, সেই সমস্ত চরিত্রের উৎস, তাদের ইতিবৃত্ত বা অতীত ইতিহাস সম্পর্কে ছোট -বড় গল্প যেন লেখকের মনে আগে থেকেই তৈরি থাকে। তাদের এই ব্যাকগ্রাউন্ডের ওপরেই কিন্তু নির্ভর করবে তাদের আগামী কার্যকলাপ, যা লেখক জানেন, আন্দাজও করতে পারেন কোথায়, কীভাবে তাদের চরিত্রের আকস্মিক পরিবর্তন ঘটতে পারে! এই ঘটনাগুলোই পাঠককে সেই চরিত্র সম্পর্কে ভাবতে বাধ্য করবে, তাকে বিশ্লেষণ করতে উঠে পড়ে লাগবে পাঠক! সবাই নিজের নিজের মতো করে থিওরি খাঁড়া করার চেষ্টা করবে - আর সেখানেই কিন্তু একজন ঔপন্যাসিকের সার্থকতা।
.
৯. লেখনীর যাত্রাপথকে উপভোগ করুন, অভিলক্ষ্যের প্রতি মনোনিবেশ নয় : সর্বোপরি, উপন্যাস লিখতে হলে, উপন্যাসের কাহিনিকে ভালোবেসে লেখা শুরু করুন। কতটা সফল হবে এই উপন্যাস, কতটা জনপ্রিয় করে দেবে আপনাকে --এসব ভাবনা ভুলেও মনে আনবেন না। বহু ব্যবহারে ক্লিশে হয়ে যাওয়া অমোঘ সত্যই বলছি --
কর্ম করে যাও, ফলের আশা কোরো না।
পরিশেষে, অগ্রিম শুভেচ্ছা রইল আমাদের ভবিষ্যৎ ঔপন্যাসিক এণাক্ষী র প্রতি। আশা করছি বাংলা কোরা খুব শিগগিরই একজন ভীষণ সফল কথাসাহিত্যিককে পেতে চলেছে নিজেদের মধ্যে :)
0 Comments